বেকারত্ব নিরসন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কাঁকড়া চাষ!

কাঁক্ড়া আর্থোপোড শ্রেণির শক্ত খোলসবিশিষ্ট জলজ প্রাণী। প্রজাতি ভিত্তিক মিঠা ও লোনা পানি, উভয় পরিবেশে কাঁক্ড়া পাওয়া যায়। মিঠা পানিতে চার প্রজাতির এবং লোনা পানিতে এগারো প্রজাতির কাঁক্ড়া রয়েছে। মিঠা পানির কাঁক্ড়া আকারে ছোট এবং লোনা পানির কাঁক্ড়া আকারে বেশ বড় হয়। লোনা পানির কাঁক্ড়া সমুদ্রে বসবাস করে।
মিঠা পানির কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হয় না। সামুদ্রিক বড় আকারের কাঁক্ড়া বিদেশে রপ্তানি হয়। তাছাড়া সামুদ্রিক এগারো প্রজাতির কাঁক্ড়ার মধ্যে একমাত্র শিলা কাঁক্ড়া রপ্তানি হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম সাইলা সিরেটা। অনেক স্থানে এ কাঁকড়া ম্যাডক্রাব নামে পরিচিত।
বিদেশে শিলা কাঁক্ড়ার মাংসই প্রিয় খাদ্য। বাংলাদেশে সর্বত্র সব শ্রেণির লোকের কাছে কাঁক্ড়া অতি পরিচিত প্রাণী। কাঁক্ড়া মৎস্য সম্পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয়ভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী খাদ্য হিসেবে কাঁকড়া গ্রহণ না করলেও বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ ইউরোপ মহাদেশেও কাঁক্ড়ার চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৪ কোটি টাকার কাঁক্ড়া বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। বিশ্ব বাজারে কাঁক্ড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর সংগ্রহ প্রক্রিয়াও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি কাঁক্ড়ার চাষপদ্ধতির কলাকৌশল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে কাঁক্ড়া চাষ প্রক্রিয়া এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। বর্তমান রপ্তানিকৃত কাঁক্ড়ার প্রায় সবটাই উপকূলীয় চিংড়ি খামার ও সমুদ্রের মোহনা নদী এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে।
পরিচিতি:
কাঁক্ড়া বা ম্যাডক্রাব আফ্রিকার পূর্ব উপকূলীয় ভারত উপকূল এবং ইন্দোপেসিফিক অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ এলাকায় দেখা যায়। এসব কাঁক্ড়ার চক্ষুপুঞ্জের দুই পাশে Carapace-এর ওপরে নয়টি দাঁত রয়েছে, যাকে Serrations বলা হয়। সিরাসনের সংখ্যা দিয়ে কিশোর কাঁক্ড়া চেনা যায়। বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র কাঁক্ড়া পাওয়া যায়। কাঁক্ড়ার বয়স সধারণত ১৬-১৮ মাসের হলেই পূর্ণবয়স্ক বা প্রজননক্ষম হয়।
এসময় একটি কাঁক্ড়ার ওজন হয় ৩০০-৫০০ গ্রাম। একটি কাঁকড়া সর্বোচ্চ ৫ কেজি পর্যন্ত ওজনের পাওয়া গেছে। সাধারণত এক বছর বয়সের কাঁকড়ার ওজন ৪০০-৫০০ গ্রাম হয়ে থাকে। বাগদা চিংড়ির মতো স্ত্রী কাঁক্ড়া গভীর সমুদ্রে ‘নউপ্লি’ ছেড়ে থাকে। যা পরে পাঁচটি লার্ভা স্তরে পার হয়ে ম্যাগালোপা ও পোস্ট লার্ভা স্তরে উপনীত হয়। এরা জোয়ার, ঢেউ ও বাতাসে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ এলাকায় ভেসে আসে এবং কিশোর স্তরে উপনীত হয়।
একটি স্ত্রী কাঁক্ড়া ১-৮ মিলিয়ন ডিম দিতে পারে। বাগদা চিংড়ির মতো কাঁক্ড়ার খোলস রয়েছে, যা চিংড়ির চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত। দৈহিক বৃদ্ধির জন্য কাঁক্ড়া খোলস পরিবর্তন করে থাকে। কাঁক্ড়ার নিজ প্রজাতি ভক্ষণ প্রবণতা রয়েছে। কাঁকড়ার শক্ত সারসী বা চিমটা দ্বারা সহজে অন্য প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে।
কাঁক্ড়া মাটিতে এবং বাঁধে গর্ত করতে পছন্দ করে। ডুবন্ত গাছের শেঁকড়ে ও ডালপালায় এরা আশ্রয় নেয়। তাই ম্যানগ্রোভ এলাকায় এদের পাওয়া যায়। পানি ছাড়া কাঁক্ড়া দীর্ঘসময় বাঁচতে পারে এবং হেঁটে হেঁটে এক স্থান থেকে সহজে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে
কাঁক্ড়া চাষের সুবিধাসমূহ:
বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে চাষের পরিবেশ বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা থাকায় এর উৎপাদন লাভজনক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পোনা (কিশোর) পাওয়া যায়। কাঁক্ড়ার খাবার স্বল্পমূল্যে গ্রহণ সম্ভব। ওজন হিসেবে কাঁক্ড়ার বৃদ্ধির হার বেশি। পঁচা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ রক্ষা করে।
কাঁক্ড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ
বাগদা চিংড়ির ন্যায় কাঁকড়া উপকূলের লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায। কাঁকড়া চাষের মাটি ও পানির গুণাবলি নিম্নরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মাটির গুণাবলি
ক. নরম দোঁআশ বা এঁটেল মাটি
খ. হাইড্রোজেন সালফাইট ও অ্যামুনিয়া গ্যাসযুক্ত মাটি
গ. জৈব পদার্থ ৭%-১২%
ঘ. অ্যাসিড সালফেটমুক্ত মাটি
ঙ. হালকা শ্যাওলা ও জলজ আগাছাযুক্ত পরিবেশ।
পানির গুণাবলি
ক. লবণাক্ততা ১০-২৫ পিপিটি
খ. তাপমাত্রা ২৫-৩০ সে.
গ. পিএইচ ৭.৫-৮.৫
ঘ. অ্যালকালিনিটি ৮০ মি.গ্রা/লি.
ঙ. হার্ডনেস ৪০-১০০ পিপিএম
চ. দ্রবীভূত অক্সিজেন ৪ পিপিএমের ঊর্ধ্বে
কাঁক্ড়া চাষের পুকুর নির্মাণ
বাগদা চিংড়ি চাষের পুকুরের ন্যায় কাঁক্ড়ার পুকুরের পানি ধারণের জন্য শক্ত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। কাঁক্ড়া হেঁটে বেড়াতে অভ্যস্ত। তাছাড়া মাটিতে গর্ত করে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। তাই বাঁধের অভ্যন্তরে বেড়া স্থাপন করা আবশ্যক। বেড়ার উচ্চতা পানির ওপরে ০.৫ মিটার রাখতে হবে।
পুকুরের অভ্যন্তরে এই বেড়া বাঁশের ঘন পাটা, ঘন কঞ্চির বুনন, সিমেন্টের দেওয়াল বা অ্যাসবেস্টাস দ্বারা দেওয়াল তৈরি করা যায়। এই বেড়া কমপক্ষে ০.৫ মিটার মাটির নিচে বসিয়ে দিতে হবে। যেন কাঁক্ড়া বেড়ার নিচে দিয়ে গর্ত করে পালিয়ে যেতে না পারে। এ ছাড়া বেড়ার বুনন এমন হতে হবে যেন কিশোর কাঁক্ড়া ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।
এ ছাড়া অন্য ক্ষতিকর প্রাণীও যেন কাঁক্ড়ার পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে। পুকুর শুকানো এবং পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাগদা চিংড়ির ন্যায় গেট বা বাক্স নির্মাণ করে পানি সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুকুরের আয়তন ০.২-১.০ হেক্টর হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। পুকুরের গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার রাখা ভালো।
খাবার সরবরাহ
কাঁকড়া সর্বভূক। এরা সাধারণত জীবন্ত খাদ্য পেতে পছন্দ করে। ছোট ছোট মাছ, সামুদ্রিক ক্রিমি, শামুক, ঝিনুক, কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে। তবে ময়লা ও পচা জৈব পদার্থ জাতীয় খাবারও এরা খায়। খাদ্য হিসাবে ছোট গুড়া মাছ, শামুক, ঝিনুকের মাংস, চিংড়ি ও চিংড়ির মাথা, বিভিন্ন প্রকার দেহাবশেষ ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
কাঁক্ড়ার খোলস তৈরির জন্য ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োজন। তাই মাংসের হাড় বা কাঁটাও কাঁকড়া খেয়ে থাকে। এ ছাড়া চালের কুড়া, গমের ভুষি, আটা, ফিস মিল ইত্যাদি মিশ্রণপূর্বক কাঁকড়ার খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। কাঁকড়ার দেহের বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ট্রেতে খাবার দিয়ে খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ পূর্বক খাবার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। কাঁক্ড়া বাগদা চিংড়ির ন্যায় নিশাচর প্রাণী। তাই বিকেলে বা সন্ধ্যায় ও রাতে প্রত্যহ ২-৩ বার খাবার দিতে হয়।
কাঁক্ড়া আহরণ ও বাজারজাতকরণ
মজুতের ৩-৪ মাস পর কাঁক্ড়া আহরণ করা যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে চাষের উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে জুলাই মাস। এ সময় পানির গুণাগুণ ও তাপমাত্রা উপযুক্ত পর্যায়ে থাকে। কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের চাই অথবা জালের তৈরি ফাঁদ সবচেয়ে উপযুক্ত। ধরার সময় কাঁকড়ার পা ভেঙে গেলে বাজারজাত করা যায় না।
লিফ্ট নেট বা চাই ফাঁদে খাবার দিয়ে কাঁক্ড়া পর্যায়ক্রমে ধরা যায়। কাঁকড়া ধরার আগেই পুকুরে খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। কাঁকড়া একপাত্র থেকে অন্য পাত্রে নেওয়া বা রাখার জন্য বাঁশের চিমটা এমন ভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন পা ভেঙে না যায়। কাঁকড়াকে পেছন দিয়ে চিমটা বা হাত দিয়ে ধরা যায়। বর্তমানে জীবন্ত কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
তাই কাঁকড়া চিমটা বা প্লাস্টিকের ফিতা দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে ঝুঁড়িতে ভরে বাজারজাত করা যায়। পরিবহনের সময় ঝুড়িতে স্যাঁতসেঁতে ভাব বজায় রাখার জন্য লবণ পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। কাঁকড়ার ঝুড়ি অন্ধকারে/ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে রাখতে হয়। বাংলাদেশ থেকে এখনো সিদ্ধ করা অথবা হিমায়িত কাঁকড়া বিদেশের বাজারে বাজারজাত করা হয় না। যদি ওই অবস্থায় রপ্তানি করা যেত, তবে পরিবহন খরচ অনেক কম হতো।
পরিশেষে, কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ আমাদের দেশের উপকূল অঞ্চলে রয়েছে। যদিও এর চাষ এখনো তেমন প্রসার লাভ করেনি। কাঁকড়ার রপ্তানি বাজারদর হিসাবে এর চাষ বেশ লাভজনক। সঠিকভাবে চাষ করা গেলে বর্তমান হিসাবে প্রতি কেজিতে ৬০ টাকারও বেশি নীট লাভ করা যায়। কাঁকড়াও একটি চাষযোগ্য প্রাণী এবং এর উৎপাদন একটি লাভজনক বিনিয়োগ।
বিষয়টি প্রদর্শনের জন্য দেশে কাঁকড়া খামার স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারি পর্যায়ে করতে হবে। বর্তমানে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব মোচনেও সহায়ক হবে। জীবন্ত কাঁকড়া রপ্তানির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। কাঁকড়া চাষ এবং উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ওপর ন্যাস্ত করতে হবে।
শা/আ/দি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: