নিজের না-পাওয়ার যন্ত্রণাকে সেবার শক্তিতে রূপ দিলেন রফিকুল ইসলাম

“আমার মা-বাপ বাইচ্চা থাকলে তাঁদেরই তো পালতাম। ছোটবেলায় মা–বাবাকে হারাইছি, সেই কষ্টই আমাকে শেখায় রাস্তায় ফেলে দেওয়া মা–বাবাকে নিজের মনে করে আগলে রাখতে।” – এভাবেই বলছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চরকামটখালী গ্রামের ‘মাতৃছায়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধাশ্রম’-এর পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম।
ছোটবেলায় পিতামাতাকে হারিয়ে বড় হওয়া রফিকুল ইসলাম জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, বার্ধক্যে মানুষ কীভাবে হয়ে পড়েন একা আর অবহেলিত। দীর্ঘ ২০ বছর হাসপাতাল জীবনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন – ফুটপাতে, হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকা অসহায় প্রবীণ মানুষদের। সেখান থেকেই জন্ম নেয় একটি মানবিক উদ্যোগ – “মাতৃছায়া”।
মাতৃছায়ার শুরু ও বিস্তার
২০১৮ সালে নিজস্ব ৮ শতাংশ জমিতে একটি টিনশেড ঘরে রফিকুল শুরু করেন আশ্রয়কেন্দ্রটি। ২০১৯ সাল থেকে পরিচয়হীন, পরিত্যক্ত ও অসহায় প্রবীণরা এখানে আশ্রয় পেতে শুরু করেন। পরে ২০২২ সালে অ্যাপেক্স ক্লাব অব ময়মনসিংহ আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে দেয় আশ্রয়কেন্দ্রটির জন্য।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে আশ্রয় পেয়েছেন মোট ৩৩ জন প্রবীণ। এদের মধ্যে ১২ জন মারা গেছেন, ৪ জন ফিরেছেন পরিবারের কাছে। বর্তমানে ১৪ জন নারী, ২ জন পুরুষ ও ১ শিশু রয়েছেন মাতৃছায়ায়।
মানবিকতায় গড়া পরিবার
রফিকুল ইসলাম বলেন, “মাইনসের কাছ থাইক্কা পুরান কাপড়, খাবার, ওষুধ চাইতে হয়। ১০ জনের সহায়তায় খাওনের ব্যবস্থা করি। যতটা পারি, ততটা করি। যত দিন বাঁচি, এই মানুষগুলোর পাশে থাকব।”
তাঁর সঙ্গে আছেন স্ত্রী কল্পনা আক্তার, যিনি প্রতিদিনের সেবা ও ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করেন। তিনি বলেন, “অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ, অনেকেই সন্তানদের ফেলে যাওয়ার শিকার। আমরা চেষ্টা করি মা–বাবার মতো করে যত্ন নিতে।”
জীবনের গল্প, যা ছুঁয়ে যায়
মাতৃছায়ায় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের প্রত্যেকের পেছনে রয়েছে হৃদয়বিদারক গল্প:
- নাসিমা বেগম (৩৪): বাঁ চোখ নেই, অসুস্থ শরীরে রাস্তায় পড়ে ছিলেন চার বছরের মেয়ে মাইশাকে নিয়ে। একদল তরুণ তাঁদের এখানে এনে দেন। এখন শিশুটি ঘুরে বেড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রজুড়ে।
- ‘তারার মা’ (প্রায় ৯০): মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর স্ত্রী, সন্তান না থাকায় স্বজনরা একসময় তাঁর দেখভাল করতেন। তিন বছর আগে তাঁকে এখানে রেখে গেছেন দেবরের পরিবার। এখনো বিশ্বাস করেন, “হোসনা আইসা লইয়া যাইব।”
- জরিনা বেগম (৭৫): দুই ছেলে মারা যাওয়ার পর, পুত্রবধূ ও নাতিরা তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ওরা আমারে ভাত দেয় না, বাড়ির ঠাঁইও দিল না।”
- তহুরুন্নেছা: ছয় মাস আগে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ নিয়ে আসে তাঁকে। পরিচয় আছে, স্মৃতিও কিছুটা আছে, কিন্তু সন্তান তাকে ফেলে গেছে পথে।
- শাহজাহান মিয়া (৬৫): একসময় সড়ক বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। নিজের হাতে সন্তানদের বড় করেছেন, কিন্তু আজ আশ্রয় নিতে হয়েছে মাতৃছায়ায়। বলেন, “ছেলে ফোন দেয়, কিন্তু আমায় এখানে রেখে গেছে। অভিযোগ নাই।”
সম্প্রীতির ছায়ায় সমাজ
রফিকুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর গ্রামবাসী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। রতন মিয়া ও হাসেন মিয়া বলেন, “রফিক অসহায় মা–বাবাদের যেভাবে দেখাশোনা করে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা যতটুকু পারি, সাহায্য করি।”
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার বলেন, “রফিকুল ইসলাম অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছি।”
মা/ম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: