sportsmaster@gmail.com রবিবার, ৩রা আগস্ট ২০২৫
১৯শে শ্রাবণ ১৪৩২

‘ল্যাংড়া-আতুর’ নয়, আমি একজন যোদ্ধা — লুপাসে আক্রান্ত মারিয়ার সাহসী পথচলা

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: ০৮ জুলাই ২০২৫ ১৮:০৭ পিএম

ফাইল ছবি

ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলেন মারিয়া আফেন্দী। স্কুল-কলেজে খেলাধুলায় একের পর এক পুরস্কার জিতেছেন—দৌড়, ব্যাডমিন্টন, গোলক নিক্ষেপ, উচ্চ ও দীর্ঘ লম্ফে ছিলেন সেরা। কিন্তু হঠাৎ করেই থেমে যায় তাঁর সবকিছু। এক অজানা রোগ কেড়ে নেয় তাঁর স্বাভাবিক জীবন, হাঁটা-চলা এমনকি দাঁড়ানোর সামর্থ্যটুকুও।

রোগটির নাম—লুপাস।

লুপাস কী এবং কেন ভয়ংকর?

লুপাস বা সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথ্রোমেটোসিস (SLE) এমন একটি রোগ, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজ শরীরেরই বিরুদ্ধে কাজ করে। এতে ত্বক, হাড়ের সন্ধি, কিডনি, ফুসফুস, এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটির সভাপতি ডা. সৈয়দ আতিকুল হক জানান, এটি একটি জটিল, আজীবন বয়ে বেড়ানো রোগ। রোগটি নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়—বিশেষ করে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের মধ্যে।

লক্ষণগুলোও সাধারণ রোগের মতো—জ্বর, ফুসকুড়ি, গিরায় ব্যথা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ত্বকের সমস্যা, কিডনির জটিলতা ইত্যাদি। অনেকেই বুঝতে পারেন না, ফলে দেরি হয় চিকিৎসায়।

মারিয়ার শুরুটা কষ্টের, কিন্তু থামেননি তিনি

মারিয়ার শরীরে প্রথম ধরা পড়ে জ্বর, মুখে ঘা ও গিরায় প্রচণ্ড ব্যথা। ধীরে ধীরে চুল ঝরে পড়ে, দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। এক সময় তাঁর নিতম্বের হাড়ে টিস্যু ক্ষয় (অ্যাভাসকুলার নেক্রোসিস) দেখা দেয়, ছয় মাস বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়। ভাই কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেতেন।

২০১৭ সালে কিডনিও আক্রান্ত হয়। তবে পড়াশোনা ছাড়েননি। শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।

বিয়ে, অপমান ও বিচ্ছেদ

২০১৭ সালে এক চিকিৎসকের সঙ্গে বিয়ে হয় মারিয়ার। বিয়ের আগে তাঁর অসুস্থতার কথা জানা থাকলেও, শাশুড়ি মেনে নিতে পারেননি।

তাঁকে শুনতে হতো, ‘ল্যাংড়া-আতুর মেয়ে ছেলের সম্মান নষ্ট করছে।’

শাশুড়ির চাপে মারিয়াকে ফেসবুকে তাঁর ছবি না দিতে বলা হতো, কারণ তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতেন। স্বামী চুপ থাকলেও মায়ের পক্ষেই ছিলেন। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে।

‘MAP’s দিনকাল’—লুপাস রোগীদের জন্য আশার আলো

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই মারিয়া আজ লুপাস রোগীদের পাশে দাঁড়াতে চান। চালু করেছেন ফেসবুক পেজ—‘MAP's দিনকাল’, যেখানে তিনি রোগটি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করেন। আক্রান্তদের সাহস দেন, বলেন—‘রোগ লজ্জার কিছু নয়, লড়াই করলেই পথ পাওয়া যায়।’

মারিয়া বলেন, ‘রোগ আমাকে আটকাতে পারেনি, তবে আমাকে বদলে দিয়েছে। এখন আমি জানি, কে আমার, কে নয়।’

প্রতি মাসে তাঁর চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। তিনি চান, লুপাস রোগীদের জন্য সরকারি সহায়তায় একটি বিশেষ তহবিল গঠিত হোক।

লুপাস রোগী মানেই সবকিছু শেষ নয়

লুপাসে আক্রান্ত আরও এক নারী—৪৭ বছর বয়সী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক—জানান, এসএসসি পরীক্ষার সময়ই তাঁর রোগ ধরা পড়ে। এরপরও তিনি উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। একসময় অসহনীয় ব্যথায় চাকরি ছাড়তে হয়।

তবে পরিবারের সহায়তা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বলেন তিনি। “এই রোগে টিকে থাকতে হলে পরিবারকে পাশে পেতে হয়,”—বললেন তিনি।

লুপাস রোগীর সংখ্যা কত?

বাংলাদেশে আনুমানিক ২ লাখ লুপাস রোগী রয়েছেন। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ২,৫০০ জন। বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

 

মারিয়া আফেন্দী প্রমাণ করেছেন—একটি রোগ জীবন থামিয়ে দিতে পারে না, যদি মন থেকে হার না মানা যায়। নিজের যন্ত্রণা ও সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি আজ অন্যদের জন্য আলোর দিশারী।

লুপাস নিয়ে তাঁর ভাষায়,

রোগ আমাকে ল্যাংড়া বানিয়েছে, কিন্তু আমি লড়তে শিখেছি। আমি পিছিয়ে নেই, আমি বেঁচে আছি। আমি একজন যোদ্ধা।

 

মা/ম

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর