শান্তির সাম্রাজ্য সিক্কিমে

সিক্কিমে প্রথম পা রাখার অনুভূতি ছিল একেবারে অন্যরকম—যেন হঠাৎ করে পৃথিবী থেকে কেটে গিয়ে কোনো স্বর্গীয় রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। বাতাসে তীব্র ঠান্ডা, কিন্তু তার চেয়েও গভীর ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। গ্যাংটকের দিকে যাত্রা শুরুর সময়ই পাহাড়ি সড়ক ধরে উপরে উঠছিল আমাদের গাড়ি, আর নিচে স্নিগ্ধ হয়ে বইছিল তিস্তা নদী। মনে হচ্ছিল, নদীটি যেন পথ দেখাচ্ছে—‘এসো, আরও ওপরে, আরও শান্তির দিকে।’
সিক্কিমের রঙ যেন সবসময়েই একটু বেশি গাঢ়। সবুজ যেন আরও সবুজ, আকাশ যেন আরও নীল, আর মেঘ যেন এখানেই এসে একটু বেশি সময় ধরে আলস্য করে।
গ্যাংটকের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর সময় এক চায়ের দোকানে পরিচয় হয়েছিল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, “এই শহরটা শুধু পাহাড় নয়, এটা মানুষকে ধীরে ধীরে নিরাময় করে।” কথাটা শুনে মনে হয়েছিল, হয়তো এ কথাটা একটু বাড়িয়ে বললেন। কিন্তু পরে যখন ছাঙ্গু লেকের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম, বুঝলাম—তিনি ঠিকই বলেছিলেন।
ছাঙ্গু লেক! ১২,৩১৩ ফুট উঁচুতে অবস্থিত হিমবাহ থেকে তৈরি সেই লেকের নীল জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। আশপাশে কোথাও শব্দ নেই, কেবল হালকা বাতাস আর বরফের স্তরে পায়ের দাগ। দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা, আর প্রকৃতির কাছে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া।
সিক্কিমের পথে পথে ছিল ছোট ছোট মনাস্ট্রি—রুমটেক, এনচে, পেমায়াংছে—যেন একেকটি নীরব প্রার্থনার স্থান। সেখানে প্রার্থনা করার নিয়ম নেই, শুধু নিঃশ্বাস নিতে হয় গভীরভাবে। বৌদ্ধ পতাকার রঙিন ঝালর বাতাসে উড়ছে আর চোখ বুজলেই মনে হয়, কেউ যেন বলছে—"সব ঠিক হয়ে যাবে"।
আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল ইয়ুমথাং উপত্যকায়। চারদিকে বরফে মোড়া পাহাড় আর রাস্তার পাশ দিয়ে ছোট ছোট গরম পানির ঝরনা। আর উপত্যকার নামটাই যেন স্বপ্ন—"ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স"। যদিও শীতকাল বলে ফুল ছিল না, তবুও প্রকৃতি একেবারে খালি হাতে ফেরায়নি। ঠান্ডা বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে গেলেও মন ছিল আশ্চর্যরকম শান্ত।
ফেরার আগে মনে হলো, সিক্কিম কোনো জায়গা নয়—এটা যেন এক প্রার্থনার ভাষা। এখানে প্রকৃতি আপনাকে নিজের আয়নায় দেখায়, নির্জনতায় কথা বলে, আর এক ধরনের ধ্যানমগ্ন প্রশান্তি ঢেলে দেয় হৃদয়ের গভীরে।
পাহাড় নামার পথে শেষবারের মতো ফিরে তাকালাম সেই মেঘে ঢাকা পাহাড়গুলোর দিকে। মনে হলো, আমি যেন সিক্কিমে এসে কিছু হারাইনি—বরং অনেক কিছু ফিরে পেয়েছি।
মা/ম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: