বান্দরবান: মেঘ ছোঁয়ার গল্প

বান্দরবান মানেই আমার কাছে পাহাড়ের আহ্বান। শহরের ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে আমরা কয়েকজন বন্ধু এক সকালে রওনা হয়েছিলাম চট্টগ্রাম হয়ে বান্দরবানের পথে। বাসের জানালা দিয়ে যখন প্রথম পাহাড়ি ঢেউয়ের মতো দৃশ্য চোখে পড়ল, মনে হলো—এটাই আসল বাংলাদেশ, যাকে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।
থানচি যাওয়ার পথে আমরা যেন এক জীবন্ত ছবির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাহাড়, ঝরনা, বাঁকখালি নদী—সবকিছু এত সুন্দর, এত মায়াময় যে কিছু সময়ের জন্য কথা বলাও ভুলে গিয়েছিলাম। প্রকৃতি আমাদের চুপ করে থাকতে শিখিয়ে দিয়েছিল।
সকালবেলা পৌঁছলাম নাফাখুম ঝরনার পাশে। হাঁটা, ঘাম, ক্লান্তি—সবকিছুকে ছাপিয়ে যখন প্রথম ঝরনার গর্জন কানে এলো, তখন মনে হয়েছিল, জীবনের সব অবসাদ এই পানির স্রোতে ধুয়ে যায়। পাহাড় কেটে আসা সেই জলধারা যেন একরাশ শক্তি, যেন প্রকৃতির প্রলাপ।
পরে গেলাম রেমাক্রি। ছিপছিপে নৌকা নিয়ে রেমাক্রি নদী ধরে চলছিলাম। চারদিকে পাহাড়, মাথার ওপরে নীল আকাশ, মাঝেমধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো মেঘ। আমার পাশে বসে থাকা বন্ধুটি বলল, “এটা স্বপ্ন নয় তো?” আমি শুধু হেসে মাথা নাড়ালাম।
চিম্বুক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে পুরো বান্দরবানকে যেন পায়ের নিচে দেখলাম। চারদিকে কুয়াশার সাদা চাদর, মাঝে মাঝে মেঘ ভেদ করে এক চিলতে সূর্যের আলো এসে পড়ছিল গায়ে। এক গুচ্ছ মারমা শিশু আমাদের দেখে হাত নাড়ছিল। তাদের হাসিতে ছিল বান্দরবানের সরলতা, যেখানে কোনো শহুরে ধান্দা নেই, নেই কোনো ছলচাতুরি।
বুদ্ধ ধাতু জাদি ও নীলাচল ভিউ পয়েন্ট বান্দরবানের সেই অংশ, যেখানে আপনি প্রকৃতিকে অনুভব করেন—উঁচু থেকে নিচে তাকালে চোখজোড়া আটকে যায় সবুজে সবুজে। মনে হয়, জীবন এত কঠিন কেন, যদি এমন শান্তি মুঠোভরে পাওয়া যায়?
রাতে আমরা ছিলাম থানচির এক আদিবাসী গেস্টহাউসে। কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, ইলেকট্রিসিটি মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু তখনই বুঝলাম, আমরা আসলে বেশি কিছু চাই না—একটু কথা, একটু প্রকৃতি আর একটি আকাশভরা তারা আমাদের শান্ত রাখার জন্য যথেষ্ট।
বান্দরবান আমাকে শিখিয়েছে—শান্তিকে ছুঁতে হলে উচ্চতায় উঠতে হয় না, গভীরে নামতে হয়। প্রকৃতির ভেতর ঢুকতে হয়, চুপচাপ শ্বাস নিতে হয়।
মা/ম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: